মানুষের মন জয় করার ১০টি উপায়

বর্তমানের ক্রমবর্ধমান আন্তঃসংযুক্ত এবং প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে, অন্যদের মন জয় করে তাদেরকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসার ক্ষমতা সফলতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা হয়ে উঠেছে। মানুষের মন জয় করার সূক্ষ্ণ ক্ষমতা আপনার  পেশাগত জীবনে, সামাজিক পরিবেশে কিংবা ব্যাক্তিগত সম্পর্কে আপনাকে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবে, আপনার জন্য সুযোগের দ্বার খুলে দিবে এবং দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক সৃষ্টি করতে সাহায্য করবে।  

মানুষের-মন-জয়-করার-১০টি-উপায়

মানুষের মনে চাপ প্রয়োগ বা তাদের আবেগ ব্যবহার করে তাদেরকে প্রতারনা করার পরিবর্তে, কার্যকরভাবে মানুষের মন জয় করার জন্য পারস্পরিকতা (Reciprocity), সামাজিক প্রমান (Social Proof) এবং ধারাবাহিকতার (Consistency) মতো মনস্তাত্ত্বিক নীতিগুলোর উপর নির্ভর করা হয়ে থাকে। পরিশীলিত যোগাযোগ কৌশল এবং চিন্তাশীল আচরণের মাধ্যমে একজন ব্যাক্তি নিজের সততা এবং সম্মান অক্ষুণ্ণ রেখেই অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি ও সিদ্ধান্তকে সূক্ষ্মভাবে নিজের দিকে নিয়ে আসার জন্য তাদেরকে প্রভাবিত করতে পারেন। 

সূচিপত্রঃ মানুষের মন জয় করার ১০টি উপায় 

মানুষের মন জয় করা বনাম মানুষকে কৌশলে বশে আনা

মানুষের মন জয় করার নির্দিষ্ট কৌশলগুলোতে যাবার আগে আমাদের মানুষের উপর ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার এবং তাদেরকে কৌশলে বশে আনার মধ্যে পার্থক্য বোঝা জরুরি। মানুষের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে তাদের মন জয় করা হলো এমন একটি উপায় যা সকলের জন্য উপকার বয়ে নিয়ে আনে। এটি প্রায়ই আপনার সাথে অন্যদের বিশ্বাসমূলক সম্পর্ক গঠন করার মাধ্যমে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং একে অন্যের সাথে সম্মানজনক বোঝাপড়ার মাধ্যমে কাজ করে থাকে।   

অন্যদিকে, আশেপাশের লোকেদের সরলতার সুযোগ নিয়ে, তাদেরকে বিভিন্নভাবে মানসিক চাপ প্রয়োগ করে বা অসৎ উদ্দেশ্যের নিয়ে মানুষকে কৌশলে বশে আনা হয়। এটি অসৎ ব্যাক্তিরা নিজেদের স্বার্থে অন্যদের নিয়ন্ত্রণ বা শোষণ করতে ব্যবহার করে থাকে। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে সম্পর্ক নষ্ট হয় এবং বিশ্বাস হারিয়ে যায়। 

অপরদিকে মানুষের মনে সূক্ষ্ণভাবে প্রভাব বিস্তার করা মানুষের মন জয় করা এবং তাদেরকে বশ করার মাঝখানের ধূসর এলাকায় অবস্থান করে। তবে, আপনার উদ্দেশ্য সৎ হলে এবং আপনি আপনার আশেপাশের লোকদের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গিকে শ্রদ্ধা করে তাদের নিজের দিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করলেও সেটি নৈতিকতার দিকেই বেশি ঝুঁকে থাকে। এভাবে মানুষের মন জয় করতে হলে পারস্পরিক বোঝাপড়া এর সফলতার মূল চাবিকাঠি। 

মানুষের মন জয় করা এবং তাদের বশে আনার মূল পার্থক্য নিহিত রয়েছে উদ্দেশ্য ও স্বচ্ছতায়। মানুষ সাধারণত নিজেরা সচেতনভাবে চিন্তাভাবনা করে আপনার প্রভাবে আসতে চায়, অপরদিকে আপনি তাদেরকে কৌশলে অন্যদেরকে বশ মানাতে চাইলে আপানাকে আবেগীয় ও মানসিক প্রতরনা করে তাদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের উপর নিয়ন্ত্রন আরোপ করে তাদেরকে আপনার পক্ষে নিয়ে আসতে হবে। 

সবশেষে বলা যায়, সততার উপর ভিত্তি করে মানুষের উপর সূক্ষ্ম প্রভাব বিস্তার করে তাদের মন জয় করার একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এটি কোন জবরদস্তি বা প্রতারনা করা ছাড়াই আশেপাশের লোকেদের কাছ থেকে আপনি যা আশা করছেন সেরকম ফলাফল পেতে সয়াহক হতে পারে। অন্যের স্বাধীনতাকে সম্মান করেই আপনি আপনার আশেপাশের লোকদের সাথে একটি শক্তিশালী এবং অর্থবহ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবেন। 


মানুষের মন জয় করার ভিত্তিঃ অর্থবহ সম্পর্ক গঠন

কারও মন জয় করে তাকে প্রভাবিত করার প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো তার সাথে একটি সত্যিকারের সংযোগ তৈরি করা। একে অপরকে বিশ্বাস ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে এমন একটি অর্থবহ সংযোগ গড়ে তুলতে পারলে, মানুষকে আপনার মতামত, দৃষ্টিভঙ্গি ও আপনার চাওয়া পাওয়াগুলোর প্রতি অনেক বেশি সহানুভূতিশীল করে তোলে। মানুষদের সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হলে, তারা আবেগগত ও সামাজিকভাবে আপনার সাথে একাত্মতা বোধ করলে ,তারা আরও আগ্রহের সাথে আপনার পরামর্শ শুনতে আগ্রহী হয়  উঠবে। সূক্ষভাবে সম্পর্ক গড়ে তোলার এমন কিছু উপায়গুলো  হলোঃ

আচরন ও ভঙ্গিমা অনুকরনঃ আপনি যার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, তার দেহভঙ্গি, কন্ঠস্বর এবং কথার গতি অনুকরন করুন। এই সূক্ষ্ণ অনুকরন মানুষের মনে একধরনের পরিচিতির ভাব এনে দেয়। এমন মিল মানুষের মনে অবচেতনভাবে আপনাকে তাদের নিজেদের ব্যাক্তিত্বের সাথে সাদৃশ্যের ইঙ্গিত দেয় এবং এর ফলে তারা আপনার উপর আস্থা আনতে পারে। 

সক্রিয় শ্রোতা হওয়াঃ মানুষ স্বভাবতই তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয় যারা তাদের কথা মনযোগ দিয়ে শোনে। কারও সাথে কথা বলার সময় মাথা নাড়ানো, চোখে চোখ রেখে কথা বলা এবং কথার গুরুত্বপূর্ণ অংশ পুনরায় বলা একজন মনযোগী শ্রোতা হিসেবে বক্তার কাছে আপনাকে মূল্যবান করে তোলে। এর ফলে যার সাথে আপনি কথা বলছেন তার সাথে আপনার একধরনের বোঝাপড়াই তৈরি হয় না, বরং তার সাথে আপনার একধরনের আবেগগত সংযোগও গড়ে ওঠে। 

অভিন্ন বিষয় খোঁজাঃ একই বিষয় নিয়ে একাধিক ব্যাক্তির মধ্যে অভিন্ন আগ্রহ বা অভিজ্ঞতা তাদের মনে একধরনের অন্তর্ভুক্তির অনুভূতি তৈরি করে। শখ, পরিচিত মানুষ বা অভিন্ন মূল্যবোধ নিয়ে আশেপাশের লোকেদের সাথে স্বাভাবিক আলাপচারিতায় যুক্ত হওয়া এসব সংযোগ খুঁজে পেতে সাহায্য করে। এই অভিন্ন বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা আপনার সামাজিক সম্পর্কগুলোকে দৃঢ় করে এবং পারস্পারিক যোগাযোগকে আরও অর্থবহ করে তোলে। 

সূক্ষ্ণ প্রশংসার ক্ষমতা

প্রশংসা মানুষের মনে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তারের একটি শক্তিশালী উপায় হতে পারে, তবে তা সতর্কতার সাথে প্রয়োগ করা উচিৎ। অতিরিক্ত উচ্ছাসের সাথে বা নিজের কাজ হাসিলের জন্য স্বার্থপরভাবে দেওয়া প্রশংসা মানুষের মনে সন্দেহের উদ্রেক করতে পারে। প্রশংসা সূক্ষ্মভাবে মানুষের আত্মসম্মান বাড়ায় এবং তাদের ভালো লাগার সাথে আপনার সংযোগ ঘটাতে সাহায্য করে থাকে। 

নির্দিষ্টভাবে প্রশংসা করুনঃ "তুমি বুদ্ধিমান" বলার চাইতে "হাজারটা সমস্যার মধ্যেও তুমি সব সময় সঠিক সমাধান খুঁজে পাও" বলা ভালো। নির্দিষ্ট করে বলা প্রশংসা শুনতে অনেক আন্তরিক লাগে, এতে মনে হয় প্রশংসাকারি ব্যক্তি আমাদের নিজেদের ভালোর জন্যই এসব কথা বলছেন। এই ধরনের নির্দিষ্ট এবং বিস্তারিত প্রশংসা আপনার কথার আন্তরিকতা ও প্রভাব বাড়িয়ে তোলে। 

গুনের প্রশংসা করুনঃ একজন মানুষকে প্রশংসা করতে হলে সে কি অর্জন করেছে শুধু তার প্রশংসা না করে বরং সেটি অর্জন করতে তাকে কি পরিমানে পরিশ্রম করতে হয়েছে, তার অধ্যবসায় বা সৃজনশীলতার মত গুনের প্রশংসা করুন। এতে সেই ব্যাক্তি বুঝতে পারবে যে সে কি অর্জন করেছে তার চাইতে আপনি তার ব্যাক্তিত্বকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। এর ফলে তার সাথে আপনার আবেগগত সংযোগ (Emotional Connection) দৃঢ় হবে এবং দীর্ঘমেয়াদে সম্পর্ক দৃঢ় হবে। 

তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে প্রশংসা করুনঃ কাউকে তাদের অজান্তে প্রশংসা করা (এটা নিশ্চিত করে যে যার প্রশংসা করা হচ্ছে সে পরে শুনবে) অনেকে সময় আরও বেশি কার্যকর হতে পারে। স্বার্থপরতার ছাপ না থাকার কারনে এরকম প্রশংসাকে অনেক বেশি আন্তরিক শোনায়। যাকে প্রশংসা করা হচ্ছে সেই ব্যাক্তির কাছে আপনার তাকে নিয়ে দেওয়া মতামত অনেকে বেশি বিশ্বাসযোগ্য এবং প্রশংনীয় মনে হয়।


ফ্রেমিং এবং প্রাইমিংঃ পরোক্ষভাবে মতামত গঠন করার পদ্ধতি

ফ্রেমিং এবং প্রাইমিং হলো একধরনের কগনিটিভ বায়াস (Cognitive bias) বা জ্ঞানীয় পক্ষপাত (তথ্য বস্তুনিষ্ঠভাবে প্রক্রিয়া করার সীমিত ক্ষমতার কারণে অযৌক্তিকভাবে কাজ করার প্রবণতা), যা মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহনকে প্রভাবিত করে থাকে। মানুষ কোনভাবে তথ্য ব্যাখ্যা করবে, তা সূক্ষ্ণভাবে পরিচালনা করে আপনি আপনার ধারনাগুলোকে তাদের কাছে আরও আকর্ষনীয় করে তুলে ধরে তাদের মন জয় করতে পারবেন। এই পদ্ধতিগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে আপনি মানুষের মনযোগ নিজের দিকে টেনে নিয়ে কোন জিনিস এমনভাবে আপনার সুবিধামতো ব্যাখ্যা করতে পারবেন যে কেউ বুঝতেই  পারবে না যে আপনি তাদেরকে প্রভাবিত করছেন। 

ফ্রেমিংঃ আপনার ধারনাগুলোকে এমনভাবে উপস্থাপন করুন, যাতে ধারনাগুলোর সম্ভাব্য ঝুঁকির চেয়ে উপকারিতাগুলো বেশি গুরুত্ব পায়। তথ্য উপস্থাপনের ভাষা অনেকটাই নির্ধারন করে তা কিভাবে গ্রহন করা হবে। যেমনঃ "আমরা লস খেতে পারি" বলার চেয়ে "এই কৌশল মেনে চললে আমরা বিনিয়োগ করে লাভ করব।" বলা আপনার বক্তব্যকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করতে সাহায্য করবে। 

প্রাইমিংঃ আপনি কারও মতামতকে প্রভাবিত করতে চাইলে তাকে আগে থেকেই সংশ্লিষ্ট ধারনা বা আবেগের উল্লেখ করুন। মূল বার্তা দেওয়ার আগে সূক্ষ্ণভাবে কিছু ধারনা তুলে ধরলে, মানুষ সেটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করে থাকে। উদাহরনস্বরুপ, আপনি যদি কাউকে আপনার মতামত বা যুক্তির দিকে নিয়ে আসতে চান তাহলে তার কাছে আপনার মূল ধারনা উপস্থাপন করার আগে সেই ধারনা সংশ্লিষ্ট কিছু শব্দ নিয়ে শ্রোতার সাথে অল্পসল্প আলোচনা করে দেখুন যে সে আপনার কথা শোনার জন্য প্রস্তুত আছে কি না। 

মানুষের-মন-জয়-করার-১০টি-উপায়



পারস্পরিকতাঃ পাওয়ার জন্য দেওয়া

মানুষ স্বভাবগতভাবেই উপকারের প্রতিদান দিতে চায়। কারো কাছে মূল্যবান কিছু-তথ্য, সাহায্য, প্রশংসা-সুক্ষ্ণভাবে প্রদান করলে তাদের মনে আপনার প্রতি একধরনের দায়বদ্ধতার অনুভূতি তৈরি হয়। যখন মানুষ আপনার কাছে নিজেদের ঋণী বোধ করে, তখন তাদের আপনার ধারনা বা লক্ষ্যকে সমর্থন করার সম্ভাবনা বেশি থাকে। 

প্রতিদান আশা না করে উপকার করুনঃ মানুষের মন জয় করার জন্য কাউকে কোন উপকার করে তৎক্ষণাৎ কোন প্রতিদান আশা করবেন না। আপনি যাকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন সে যদি আপনার উদারতাকে কৌশল হিসেবে মন করে, তখন আপনি তাদের উপর প্রভাব হারিয়ে ফেলবেন। পারস্পরিকতার অনুভূতি স্বাভাবিকভাবে গড়ে উঠতে দিন, যাতে আপনি যার উপকার করছেন সে আপনার প্রতি সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা অনুভব করে এবং নিজে থেকেই প্রতিদান দিতে চায়।  

ব্যাক্তিগত করে তুলুনঃ মানুষের মন জয় করার জন্য একটি বিশেষভাবে মানানসই উপকার বা সৌজন্যতাপূর্ণ আচরন সাধারন কিছুর চেয়ে অনেক বেশি অর্থবহ হতে পারে। যখন আপনি কারো ব্যাক্তিগত প্রয়োজন ও পরিস্থিতির প্রতি সচেতনতা প্রকাশ করে কাউকে সহায়তা করে থাকেন, তখন আপনার সাহায্য তাদের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। এই ব্যাক্তিগত ছোঁয়া মানুষের মনে আপনার প্রতি একটি শক্তিশালী দায়বদ্ধতার অনুভূতি তৈরি করে। 

আবেগকে মূল্য দিনঃ আপনার আশেপাশের মানুষকে তাদের জীবনের বিভিন্ন সমস্যায় তাদেরকে সহানুভূতি প্রদর্শন, তাদেরকে সমর্থন দেওয়া এবং প্রয়োজনে তাদের সময় দেওয়া- এই আবেগগত উপহারগুলো মানুষের মন জয় করার জন্য বস্তুগত দানের মতই শক্তিশালী ও কার্যকর ভূমিকা পালন করে থাকে। এ ধরনের অবদান মানুষের সাথে আপনার এমন এক ধরনের আবেগিক বন্ধন গড়ে তুলবে যা টাকা দিয়ে কেনা যায় না। যখন মানুষ অনুভব করতে পারে যে তাদের কথা শোনা হচ্ছে এবং তাদের মতামতকে মুল্য দেওয়া হচ্ছে, তখন তারা প্রতিদান দিতে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠে। 


পছন্দের জাল বিছানো

মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করে তাদের মন জয় করার একটি অন্যতম কার্যকর কৌশল হলো তাদের সামনে একগাদা পছন্দের জাল বিছিয়ে রাখা, অথচ ধীরে ধীরে তাদেরকে আপনার পছন্দের ফলাফলের দিকে পরিচালিত করা। এই পদ্ধতিটি অন্যদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে স্বীকার করেও অন্যদেরকে আপনার কাঙ্ক্ষিত পথে পরিচালিত করতে উৎসাহ যোগায়। নিচের উপায়গুলোর মাধ্যমে পছন্দের জাল বিছানো যেতে পারেঃ 

বিকল্প দেওয়াঃ যখন আপনি কাউকে আপনার দিকে নিয়ে আসতে চাইছেন বা কারও কাছে কোন কিছুর প্রস্তাব করছেন, তখন আপনি তাদের সামনে এমনভাবে দুই বা তিনটি বিকল্প উপস্থাপন করুন যেখানে আপনার পছন্দের বিকল্পটি তাদের কাছে সবেচেয়ে আকর্ষনীয় বলে মনে হবে। এত মানুষ মনে করে তারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যদিও আপনি তাদের আপনার পছন্দের দিকে টেনে নিচ্ছেন। এটি মানুষের মনে স্বাধীনতার অনুভূতি তৈরি করে তাদেরকে দ্রত সিদ্ধান্ত গ্রহনে সহায়তা করে থাকে। 

বিপরীত চিত্র তৈরি করাঃ আপনার কাঙ্ক্ষিত বিকল্পটির পাশে একটি কম আকর্ষনীয় বিকল্প রাখুন যাতে করে মানুষের মনে আপনার প্রস্তাবটিকে আরও আকর্ষনীয় মনে হয়। মানুষ সাধারণত তুলনা করে সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করে থাকে। এই কৌশলটি সেই মনস্তত্ত্বকে কাজে লাগায়। 

নেতৃত্বমূলক প্রশ্ন করাঃ "আপনি কি সোমবার থেকে শুরু করতে চান, না কি বুধবার?"--এমন ধরনের প্রশ্ন মানুষের ভাবনাকে সূক্ষ্ণভাবে একটি নির্দিষ্ট দিকে পরিচালিত করে। এতে লোকেদের মনে হয় তারা একটি নির্দিষ্ট উপায়কে বেছে নিচ্ছে, কিন্তু আসলে আপনি তাদেরকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। এটি মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহন করার প্রক্রিয়াকে সহজ ও নিয়ন্ত্রিত রাখে। 

কর্তৃত্ব ও সামাজিক প্রমানকে কাজে লাগানো

মানুষ সাধারণত তাদেরকেই অনুসরন করে যাদেরকে তারা বিশ্বাসযোগ্য মনে করে অথবা তাদের কাছে মনে হয় যে একজন নির্দিষ্ট ব্যাক্তিকে আগে থেকেই অনেকে অনুসরন করে আসছে। আপনি নিচের উপায়গুলো ব্যবহার করে সূক্ষ্মভাবে আপনার প্রভাব বাড়াতে পারেন। এই কৌশলগুলো মানুষের মধ্যে আপনার প্রতি বিশ্বাস তৈরি করবে এবং মানুষকে আপনার কথা শুনতে আগ্রহী করে তুলবে। 

নির্দিষ্ট কর্তৃত্ব প্রকাশঃ আপনার কোন বিষয়ে প্রাসঙ্গিক অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান থাকলে তা অহংকার প্রকাশ না করেই সহজভাবে উল্লেখ করুন। উদাহরনস্বরুপ, "আমি যখন একই রকম একটি প্রজেক্টে কাজ করছিলাম, তখন আমরা দেখেছিলাম যে... " এমন বাক্য আপনার বিনীত হবার দক্ষতা প্রকাশ করে। এটি আপনার সহকর্মি ও আশেপাশের লোকেদের কাছে আপনাকে দাম্ভিক না হয়েই আত্মবিশ্বাসী হিসেবে প্রকাশ করে থাকে। 

তৃতীয় পক্ষের স্বীকৃতিঃ অন্য কেউ যদি আপনার সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করে, সেটি আত্মপ্রচারের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাব ফেলে। মানুষ অন্যের মুখে নিজের প্রশংসাকে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে করে। এটি আপনার আশেপাশের লোকেদের কাছে আপনার বিশ্বাসযোগ্যতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাড়িয়ে দেয়। 

জনপ্রিয়তা তুলে ধরাঃ কোন নির্দিষ্ট বিষয়ে মানুষের উপর নিজের মতামত সরাসরি উল্লেখ করার পরিবর্তে গোষ্ঠীগত অনুমোদনের সুক্ষ্ণ উল্লেখ করা মন্তব্য, যেমন "অধিকাংশ বিশেষজ্ঞয়ই এই পদ্ধতিকে কার্যকর মনে করে"---এই ধরনের মন্তব্য সামাজিক প্রমানের শক্তিকে ব্যাবহার করে। এতে মানুষের মনে হয় যে তারা একা আপনার প্রস্তাব গ্রহন করছে তা নয়, বরং আরো অনেক জ্ঞানি গুনি ব্যাক্তিই একই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটি তাদের আপনার অনুকূলে সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে আত্মবিশ্বাস যোগায়। 


সময়জ্ঞান ও ধৈর্য ধারন করা

মানুষের উপর প্রভাব বিস্তার করে তাদের মন জয় করার ব্যাপারটি শুধু আপনি তাদেরকে কী বলছেন তা নয়, বরং কখন এবং কীভাবে বলছেন সেটিও গুরুত্বপূর্ণ। একজন সূক্ষ্ণ প্রভাবক জানেন কখন কথা বলতে হয়, কখন থামতে হয়, এবং কখন লোকেদের মনে তার পছন্দের ধারনার বীজ বপন করতে হয়। মানুষের মনে সূক্ষ্ণ প্রভাব বিস্তারের জন্য দীর্ঘমেয়াদী কৌশলের প্রয়োজোন হয়, যাতে করে আপনি তাদের মনে বিশ্বাস সৃষ্টি করে তাদের মনে আপনার পছন্দের ধারনা ও দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকে ধীরে ধীরে গেঁথে দিতে পারেন। 

সুযোগের অপেক্ষা করুনঃ  মানুষ তখনই একটি ধারনাকে বিবেচনা করতে রাজী থাকে যখন তাদের মন শান্ত থাকে বা যখন বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে আলোচনায় আসে। সময়জ্ঞান বিষয়বস্তুর মতই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করলে আপনার বার্তা আরও প্রভাবশালী হতে পারে। 

"বীজ বপনের" কৌশল ব্যবহার করুনঃ আপনি যার মন জয় করতে চান তার সাথে আলোচনার মাঝে স্বাভাবিকভাবে একটি ধারনা উল্লেখ করুন। সেই ধারনাটিকে শ্রোতার মনে গেঁথে যেতে দিন এবং সেটিকে তাদের মনে বিকাশ লাভ করার জন্য যথেষ্ট সময় দান করুন। পরে তারা কোন এক সময় নিজেরাই ধারনাটি আলোচনায় তুললে তাদের মনে হবে যে ধারনাটি তাদের মাথা থেকেই এসেছে, যার ফলে তারা তাতে আরও বেশি মনযোগ দিবে। 

চাপ প্রয়োগ এড়িয়ে চলুনঃ মানুষকে একেবারে জোর করে আপনার মতামত চাপিয়ে দেবার পরিবর্তে তাদেরকে ধীরে ধীরে আলতোভাবে দিকনির্দেশনা দিন। চাপ প্রয়োগে মানুষের মনে প্রতিরোধ তৈরি হতে পারে, কিন্তু সূক্ষ্ণ কৌশল অবলম্বন করা আপনার মতের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়। সময়ের সাথে সাথে আপনার ধারনাকে নিয়মিত একটু একটু করে উল্লেখ করা অনেক সময় একটি তীব্র চেষ্টার চেয়ে বেশি কার্যকর হয়ে থাকে। 

গল্প বলার মাধ্যমে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রন করা

মানুষ কাঁচা তথ্যের কপচপানি শোনার চেয়ে গল্প দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়ে থাকে। সুন্দরভাবে বলা একটি গল্প সুক্ষ্ণভাবে মানুষের মত পরিবর্তন করতে পারে, মানুষের কাছে আপনাকে জ্ঞানী হিসেবে প্রমানিত করতে পারে অথবা আপনার প্রতি মানুষের সহানুভূতির জন্ম দিতে পারে। গল্প বলা হলো কাউকে সরাসরি প্রভাবিত না করেই তার মন জয় করার একটি সূক্ষ্ণ কৌশল। 

ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা ব্যবহার করুনঃ আপনার ব্যাক্তিগত জীবনে ঘটে যাওয়া কোন বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রাসঙ্গিক ভাবে আপনার বন্ধু বান্ধব বা কলিগদের সাথে শেয়ার করলে তাদের মনে আপনার একটি সত্যিকারের এবং মানবিক চিত্র ফুটে ওঠে। এর ফলে অন্যরা আপনার উপর বিশ্বাস করতে ভরসা পায় এবং তারা আপনার সাথে সহজে সংযোগ স্থাপন করতে উৎসাহিত বোধ করে। যখন মানুষ আপনার মধ্যে মানবিক দুর্বলতা দেখতে পায়, তখন তারা আপনার কথা আরও মনে খুলে শুনতে আগ্রহী হয়। 

আবেগনির্ভর আকর্ষন তৈরি করুনঃ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি আপনার দিকে টেনে আনার জন্য শুকনো তথ্যের চেয়ে আবেগপূর্ণ গল্প অনেকে বেশি স্মরনীয় হয়ে থাকে। ভালোভাবে বসানো একটি আবেগঘন মুহূর্ত সাধারন একটি গল্পকে শক্তিশালী করে তোলে। এই ধরনের সংবেদনশীলতা আপনার বার্তাকে দীর্ঘস্থায়ী ও গ্রহনযোগ্য করে তোলে। 

শিক্ষণীয় দিক বা নীতিকথা অন্তর্ভুক্ত করুনঃ শ্রোতাদের কী ভাবতে হবে তা সরাসরি না বলে গল্পের মাধ্যমে তাদেরকে সেই সিদ্ধান্তে পৌছাতে দিন। এতে তারা নিজেরাই গল্পের মধ্যের অন্তর্নিহিত অর্থ খোঁজার প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে। আপনার গল্পের মধ্যে কোন নীতিকথা যখন তারা নিজেরা উপলব্ধি করতে পারবে, তখন সেটি তাদের মনে আরও গভীরভাবে প্রভাব ফেলবে।  

মানুষের-মন-জয়-করার-১০টি-উপায়



অমৌখিক যোগাযোগ স্থাপন করা

মানুষের সাথে যোগাযোগ করার জন্য কথা বলার কোন বিকল্প না থাকলেও, অমৌখিক সংকেত অনেক সময় আরও বেশি প্রভাব ফেলে। মানুষের মন জয় করার জন্য তাদের উপর সূক্ষ্ণ প্রভাব বিস্তারে শরীরের ভাষার উপর অনেকটাই নির্ভর করা হয়ে থাকে। 

খোলামেলা দেহভঙ্গি বজায় রাখুনঃ বসে থাকা অবস্থায় এক বা একাধিক ব্যাক্তির সাথে কথা বলা বা আড্ডা দেওয়া অবস্থায় হাত, পা জড়সড় করে না রেখে খোলা ভঙ্গিমায়, কারন এগুলো আপনাকে আপনার সঙ্গীদের কাছে অবচেতনভাবে আত্মকেন্দ্রিক বা স্বার্থপর মনে করাতে পারে। খোলা দেহভঙ্গি আপনাকে সহজলভ্য ও আলাপ করার জন্য প্রস্তুত দেখায়। এই ধরনের শারীরিক ভাষা অন্যরা আপনার কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে এমন বার্তা দেয়। 

সংবেদনশীলভাবে স্পর্শ করাঃ হালকা, সম্মানজনক স্পর্শ - যেমন হাত অথবা কাধে আলতো করে ছোঁয়া - সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে। তবে এটি অবশ্যই পরিস্থিতি বুঝে এবং অপর পক্ষের স্বাচ্ছন্দ্যের ভিত্তিতে ব্যবহার করতে হবে। সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে এটি মানুষের মনে আন্তরিকতা ও আস্থার বার্তা দেয়। 

আন্তরিকভাবে হাসুনঃ একটি সত্যিকারের হাসি আপনাকে মানুষের কাছে আরও সহজবোধ্য ও বন্ধুবৎসল করে তোলে। এটি শুধু আপনার নিজের মেজাজকেই ভালো করে না, বরং অন্যদের চোখেও আপনাকে ইতিবাচক করে তোলে। মানুষ সাধারণত এমন ব্যাক্তিকেই বেশি বিশ্বাস এবং পছন্দ করে, যিনি আন্তরিকভাবে হাসতে পারেন। 

কৌশলগত দুর্বলতা প্রকাশ করা

অবিশ্বাস্য মনে হলেও, মানুষের কাছে কৌশলগতভাবে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা অনেক সময় মানুষের মন জয় করার জন্য একটি শক্তিশালী কৌশল হিসেবে কাজ করতে পারে। মানুষ তাদেরকেই বেশি বিশ্বাস করে যাদের আবেগ অনুভূতি তাদের কাছে সত্যিকারের বলে মনে হয়। এটি আপনাকে অন্যদের চোখে মানবিক করে তোলে এবং এর ফলে অন্যদের বিশেষ করে নরম প্রকৃতির মানুষদের আবেগকে আপনি নিজের পক্ষে নিয়ে আসতে পারেন।  

ছোটখাট ভুল বা দুর্বলতা স্বীকার করুনঃ সহকর্মি, বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতজনদের কাছে নিজের ছোটখাট ভুল স্বীকার করা তাদের কাছে আপনার সততা এবং আত্মজ্ঞানকে প্রকাশ করে। এটি অন্যদের কাছে আপনাকে আরও মানবিক  ও আন্তরিক করে তোলে। এতে তাদের কাছে আপনার অবস্থান দুর্বল না হয়ে বরং বিশ্বাসযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। 

সাহায্য বা পরামর্শ চানঃ বিপদে পড়লে অন্যের দিকনির্দেশনা চাওয়া আপনার বিনয় এবং তাদের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের প্রতি আপনার সম্মান প্রকাশ করে। মানুষ যখন মনে করে তাদের দক্ষতাকে স্বীকৃতি জানানো হচ্ছে, তখন তারা আপনার প্রতি গভীর কৃত্তজ্ঞতা বোধ করে। এর ফলে আপনাকে যদি আবারও তাদের সাহায্য চাইতে হয়, তখন তারা আপনাকে সমর্থন করতে আরও আগ্রহী হবে। 

আন্তরিকভাবে আবেগ প্রকাশ করুনঃ  কোন ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আসল আবেগ যেমন উদ্বেগ, উচ্ছাস, বা উত্তেজনা প্রকাশ করলে আপনি আরও আকর্ষনীয় হয়ে উঠবেন। আবার, নিয়ন্ত্রিতভাবে আবেগ প্রকাশ আপনার কথোপকথনে গভীরতা এবং আন্তরিকতা আনে। এটি মানুষকে আকৃষ্ট করে এবং তাদের উপর আপনার প্রভাবকে দৃঢ় করে তোলে। 

শেষ কথা

মানুষের উপর সূক্ষ্ণ প্রভাব বিস্তার করে তাদের মন জয় করার চেষ্টা করা মানে এই নয় যে তাদেরকে আপনি নিয়ন্ত্রণ বা প্রতারনা করছেন; এর মানে হচ্ছে এটি সহানুভূতি, সঠিক সময়জ্ঞান এবং মনস্তত্বের উপর ভিত্তি করে নৈতিকভাবে তাদেরকে আপনার পক্ষে নিয়ে আসার চেষ্টা করা। মানুষ কিভাবে ভাবে ও অনুভব করে তা বোঝার মাধ্যমে আপনি আপনার পক্ষে এমন ফলাফল গড়ে তুলতে পারবেন যা সবাইকেই উপকৃত করবে। 

সবশেষে বলা যায় যে আজকের দ্রুতিগতির পৃথিবীতে জোরালো মতামত আর আক্রমনাত্বক কৌশলের ভিড়ে মানুষের উপর সূক্ষ্ণ প্রভাবের নীরব শক্তি এখন আরও মূল্যবান হয়ে উঠেছে। এটি মানুষের সিদ্ধান্তকে জোর করে নয়, বরং নম্রতার মাধ্যমে প্রভাবিত করে -  আর অনেক সময় মানুষের ভেতর অনেক গভীর পরিবর্তন আসে একবারে নরম ছোঁয়া থেকে। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

আমার ব্লগের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ২

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৩

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৪